ঘুম ভাঙতেই মেজাজটা খিঁচড়ে যায়। ঘড়িতে ভোর নটা। এ এক আপদ। যেদিন ইচ্ছে থাকে সেদিন ঘুম হয় না। আর কাজের দিন দশটার আগে উঠতে পারি না। সবই নিয়তি। রোব্বার দিন ভোর নটায় বিছানায় শুয়ে শুয়ে চোখ পিটপিট করতে করতে সেদিনই প্রথম টের পাই, যে, আমার জীবনের সমস্যা একটাই। ইচ্ছেমতো কোনো কিছুই হয় না। হবার কথা ছিল ফিল্মমেকার, হয়ে গেছি টাইপিস্ট, সারাদিন কম্পিউটার পিষছি। কেরানিগিরির একশা। লেখার কথা ছিল পথের পাঁচালি, হুতোম প্যাঁচার নকশার বেশি আর এগোল না। হতে চেয়েছিলাম বোহেমিয়ান, কিন্তু হিপি মুভমেন্ট আমার জন্মানোর আগেই শেষ হয়ে গেল। জয়দেবে বাউলদের ট্রাই করেও দেখেছি। সাধনসঙ্গিনী ব্যাপারটা মন্দ না, কিন্তু ব্যাটাদের গায়ে গন্ধ। ও পোষায় না। বিপ্লব টিপ্লব করলেও হত, কিন্তু ওসব জঙ্গুলে লাম্পট্য ধাতে সইবেনা। বাপ-মা অবশ্য সাধ করে নাম রেখেছিল বন্য, বন্ধুরা ডাকে বুনো বলে, কিন্তু ওসব বুনো রামনাথদের আর কোনো ব্র্যান্ড ভ্যালু নেই। এমনিতেই মশার কামড়ে হাত-পা ফুলে যায়, ম্যালিগন্যান্ট হলে তো আর দেখতে হবে না। তাছাড়া কাজের দিন সকাল দশটার আগে উঠতে পারিনা। সেটা অবশ্য মাইনর। এ তো ক্ষুদিরামের যুগ নয় যে ব্রাহ্মমুহূর্তে উঠে গীতা পড়ে মুগুর না ভাঁজলে অনুশীলন পার্টি থেকে কান ধরে বার করে দেবে। একবিংশ শতাব্দীতে যে যখন খুশি ঘুম থেকে উঠতে পারে। ব্রহ্মচর্যের তো বালাইই নেই। ব্যক্তি স্বাধীনতা। তাছাড়া গীতা আরেসেসের পাঠ্য, আনন্দমঠেরও কীসব কমিউনাল অ্যাঙ্গল বেরিয়েছে। ওসব ঠিকই আছে, কিন্তু সমস্যাটা হল, এখন আর গ্ল্যামারাস বিপ্লব-টিপ্লব কিছু হচ্ছে না। করতে গেলে নিজের বিপ্লব নিজেকেই বিপ্লব ম্যানুফ্যাকচার করতে হবে। সময়টাই ভুলভাল। স্বাধীনতা সংগ্রাম, হাংরি, ভিয়েতনাম, নকশালবাড়ি, পথের পাঁচালি, বার্লিন ওয়াল, তিয়েন-আন-মেন স্কোয়্যার, এমনকি ইন্টারনেট অব্দি সব শেষ। এখন শুধু খুঁটে খাওয়া। পেডিগ্রি ছাড়া আর কিছু হবার নেই। আমি সেখানেও গোল্লা। থাকি কেষ্টপুরে। ফিল্ম ইনস্টিউটের গণ্ডি মাড়াইনি, জেএনইউ চোখে দেখিনি, ইপিডাব্লু আমার কোনো প্রবন্ধ ছাপেনি। বন্ধুবান্ধবরাই পাত্তা দেয়না তো বাইরের লোক। সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে একবার এক ট্যাক্সিতে উঠেছিলাম। আর পাঁচ বছর বয়সে একবার জ্যোতি বসুর কোলে বসে ছবি তুলেছিলাম। ব্যস। পেডিগ্রি বলতে এই। কিন্তু সে ছবির নিচেও লিখে না দিলে আমাকে আমি বলে চেনা যাবে না।